Tuesday, October 3, 2017

কর্তাভজা সম্প্রদায় - The relegious community of West Bengal

কর্তাভজা হলো বৈষ্ণব সম্প্রদায় এর মতোই একটি ধর্মীয় জাতি। আপনারা  সকলেই জানেন বৈষ্ণব এর উৎপত্তি ,  তার বিস্তৃত সম্পর্কে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপ গ্রামে এর উতৎপত্তি। ধর্মগুরু সর্বপ্রথম এই ধর্মের মাহাত্ম প্রচার শুরু করেন। ধীরে ধীরে তা সারা রাজ্যে এমনকি সারা দেশে ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। এই বৈষ্ণব সম্প্রদায় এর একটি ভাগ হলো কর্তাভজা। আবার অনেকে বলেন বলেন কর্তাভজা সম্পূর্ণ আলাদা একটি ধর্ম , এর  সাথে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।যাই হোক আমি বিভিন্ন বই , ম্যাগাজিনে , ঘেটে অনেক তথ্যঃ প্রকাশ করলাম , যেইগুলো আমার হয়তো অনেকেই জানি না। তাই আমি  আজকে তোমাদের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের গল্পটা বিস্তারিত আলোচনা করলাম। 


জায়গাটা হলো নদীয়া জেলার অন্তর্গত কল্যাণী নামক গ্রামের ঘোষপাড়া এর একটি অঞ্চল। এইখানে আসতে হলে শিয়ালদাহ (কলকাতা )  থেকে ট্রেন এ করে বর্তমানে কল্যাণী এর ঘোষপাড়া স্টেশনে নামতে হবে। এইখানে সতীমাতা নাম এ একজন এর মন্দির আছে। চলতি কথায় বলা হয় সতীমাতা এর মন্দির। এই সতীমাতা মন্দির কে ঘিরে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সব ইতিহাস। তবে পুরুষদের থেকে  স্ত্রীলোকদের আধিক্য  বেশি এই দলে। এই ধর্ম সম্পর্কে "নদিয়ার ইতিহাস " গ্রন্থে পাওয়া যায় - " মেয়ে হিজড়ে পুরুষ খোজা , তবে হয় কর্তাভজা " . আমি নিজেও এর অর্থ বুজতে পারিনা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে পুরুষ দের থেকে মহিলা দের সংখ্যা প্রায় তিন গুন বেশি। এই ধর্ম একসময় বৈষ্ণব ধর্মের পরেই এর স্থান ছিলো। কিন্তু এখন আর এর অবস্থা প্রায় লুপ্ত। এই ধর্মের অনুরাগী আর প্রায় নেই বললেই চলে। নারী ও পুরুষ একসাথে এই ধর্মে বসবাস করায় সর্বনাশ সম্ভবত শুরু হয়ে গিয়েছে। তবুও সতীমাতা যেন এইখানে জীবিত। 

এই সম্প্রদায়ের আদি পুরুষ হলো আউলচাঁদ। তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে ঈশ্বর হিসাবে মান্য করেন। তাহাদের মতে শচীনন্দন শ্রী চৈতন্যদেব জগন্নাথ দেবের অঙ্গে অপ্রকট হয়ে অলক্ষ্যে আলোরপুর পরগনার খোদাবলী গ্রামে( বর্তমানে সেটি কোথায় কেউ জানে না ) বসবাস শুরু করেন। পরে তিনি এক বালকবেশে উলগ্রামে আগমন করেন (বর্তমানে যেটি বিরনগর নামে পরিচিত) . ওই বালক পরে পূর্ণচন্দ্র নামে পরিচিত হন। আরো পরে বিভিন্ন ঘটনাবলী এর মধ্যে দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত হয় ও তিনি  বাজরা গ্রামে এসে উপস্থিত হন। এই গ্রামে থেকেই তিনি সর্বপ্রথম তার ধর্মকর্ম শুরু করেন ও শীষ্যত্বও দিতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম শিষ্য হল হটুঘোষ। ধীরে ধীরে তাঁর এইধর্মের প্রভাব বাড়তে শুরু করে ও আরো লোকতার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে শুরু করেন। ক্রমে তার শিষ্যের সংখ্যা ২২ জন হয়ে ওঠে। যদিও এই ২২ জন শিষ্য সম্পর্কে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। সেগুলি পরের ব্লগে আলোচনা করা হবে। 

এই  আউলচাঁদ এর ২২ জন শিষ্যের মধ্যে একজন বিখ্যাত শিষ্য হল রামসারণ পাল। বাকিদের সেইরকম কোনো খোঁজ ও পাওয়া যায় না। তাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। যদিও খোঁজ করে ১-২ জন শিষ্য দের বংশের খোঁজ পেয়েছি। যদিও তাদের   বর্তমান প্রজন্মের আর  কাউকেই আজকাল পাওয়া যায় না। এবং যারাও দূর সম্পর্কের এক ২ জন আছেন তারা আর এইসব ইচ্ছুক নয়। কর্তাভজা থেকে শত হাত দূরে। আবার রামসরণ পালের শিষ্যত্ব গ্রহণ সম্পর্কে অনেকে অনেক মতবাদ বলে থাকেন। যাই হোক, যাই মতবাদ সত্যি হোক না কোনো  আমি যাচ্ছি পরবতী আলোচনায়। এই রামসারণ এর স্ত্রীর নাম ছিলো সরস্বতী। এই সরস্বতীর গর্ভে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলো। তাঁর পুত্রের নাম রামদুলাল। রামদুলাল এর নেতৃত্বে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিশেষ উন্নতি সাধন করেছিলো। এই রামদুলাল চারিটি স্ত্রী ছিলো।  তাঁর সব স্ত্রীর গর্ভে আবার পাঁচ টি পুত্র সন্তান হয়। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে  কুঞ্জবিহারী - তাঁর কোনো সন্তান সন্তানদিই ছিল না। মধ্যমা গর্ভে রাধামোহন ও মাথুরামোহন বলে যে দুটি সন্তান ছিলো তারাও ছিলো নিস্সন্তান। পরের স্ত্রীর গর্ভে ঈশ্বর পাল ও চুতুর্থার গর্ভে ইন্দ্রাপাল জন্মগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে রামদুলাল এ অন্যতম। এই রামদুলাল ১২৩৯ সালের চৈত্র মাসের কৃষ্ণা ত্রয়দশী তিথিতে বারুণীর দিনে মৃত্যুবরণ করেন। যেহেতু কোনো পুত্র সন্তান তাঁর যোগ্য পরিচিত হয়নি তাই রামদুলাল এর বৃদ্ধ মাতা সতীমাতা এই ধর্মের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । তিনি আরো নামে  পরিচিত -  শচীমাতা , শচীমা , সতীমা ইত্যাদি। এই দোল প্রকাশের কিছুকাল পরেই ১২৪৭ সালের অশ্বিন মাসে সতীমাতা দেহরক্ষা করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর চতুর্থ পুত্র এই সম্প্রদায়ের মালিক হিসাবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। এই ঈশ্বরচন্দ্রের আবার দুই পুত্র ছিলেন , তাহারা হলেন - ধরণী পাল ও বীরচাঁদ পাল। আবার এদিকে ইন্দ্রাচন্দ্রের তিন পুত্র ছিলো - পূর্ণচন্দ্র , রসিকলাল ও সত্যাচারণ। ইন্দ্রাপাল মারা গেলেন তাঁর অসম্মতিতে রসিক ও সত্ত্যচরণ পৃথক ভাবে কর্তাভজা চালনা শুরু করেন। রসিকলালের পরবর্তী কালে তাঁর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও সত্যাচারণ এর পুত্রদিগন একসাথে সম্প্রদায় চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কালের ক্রীড়ায় ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বিবাদী শুরু হয় ও গদি এর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের মধ্যে ভক্তি , প্রেম , সত্যনিষ্ঠা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাদের সেই সত্যনিষ্ঠা , সেই শ্রী ও সৌষ্ঠব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কিন্তু সতীমাতা এর সেই দল আজ ও  ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্মীই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উপরের চিত্রটি সেই সতীমাতা এর এ কথা বলে। 

যাই হোক না কেন , আজ এই সতীমাতা একটি  গুরুত্বপূর্ণ , পুণ্যার্থী দের মন্দির হিসাবে পরিচিত। এইখানে দোলযাত্রা উপলক্ষে অনেক বড় মেলা হয়। সেই মেলায় বিশেষ ভাবে সতীমাতা এর নাম কীর্তন ,  পূজা হয়ে থাকে। সতীমা এইখানে বিশেষ ভাবে জাগ্রত।  মন্দির টি খুব ই  সুন্দর। যারা ইচ্ছুক তাঁরা  একবার এসে দেখে যেতে পারেন।