Saturday, July 21, 2018

THE STORY OF MY LIFE -MY STORY OF MY NATIVE VILLAGE - গ্রামে একটি সপ্তাহ। ..

সময় টা তখন ২০০২ সাল। স্মার্টফোনে , ইন্টারনেট , HD  আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলেনি।
মানুষের কাছে বিনোদনের একমাত্র উপাদান ছিলো কালার টিভি ( তাও  উচ্চমধবিত্ত  পরিবারে ) ।
মধ্যবিত্তদের কাছে ছিলো সাদা কালো ( আসলে সাদা কালো সংক্ষিপ্ত ভাবে বলা হত।  
সাদা কালো টিভি আসলে ) ও রেডিও।
আর ছিলো সকালে চায়ের চুমুকে খবরের কাগজে খেলার খবর , রাজনৈতিক খবর। ছিলো  সিনেমা হল।
আর ছিলো বছরে একবার গেট -টুগেদার। এই নিয়ে চলতো জীবন। 
প্রতি বছর মার্চ মাস এলেই আমাদের পরীক্ষা শেষ। ১ মাসের বিশ্রাম র তার পর আবার পরের ক্লাসের পড়াশুনা শুরু করা। আমার  কাছে এই একমাস সময় যেন ছিলো যেন এক দিন। কবে এসে যেত আবার কবে চলে যেত। কিন্তু তার মাঝে একবার গ্রামের বাড়িথেকে ঘুরে আসতাম। বাবা প্রায় এক-দুই মাস পর  যেতেন কিন্তু আমি বছরে ১ বার। তাও এই সময়। তাই যেতে ভালো লাগতো। আর শহরের জীবন থেকে অনেক দূরে , শহরের জীবন যাত্রা থেকে অনেক দূরে যেন ভালো লাগতো। শুধু বলে সেটা বোঝানো যাবে না। এক রবিবার দেখে বেরিয়ে পড়তাম। মার্চ মাস মানে ঠিক বসন্ত কাল। তখন গরম ও নয় আবার ঠান্ডা ও নয়। কাজেই খুব ভালো লাগতো এই ভ্রমণ। রবিবার ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তাম সবাই মাইল - বাবা মা , দাদা ও আমি। তখন আমরা কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে এর কোয়ার্টার এ থাকতাম আর সেখান থেকে কাঁচারাপাড়া রেলওয়ে স্টেশন মাইল ৩ এক। ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার পথে একজায়গায় সকালে বিনামূল্যে ছোলা ও জল দান করা হতো। সেটা খেয়ে নিয়ে স্টেশন চলে যেতাম। সাইকেল রেখে সকালের কল্যাণী লোকালে চেপে বসতাম। এই ট্রেন এ চেপে শিয়ালদাহ আবার তারপর থেকে বাস এ করে হাওড়া। হাওড়া থেকে মেদিনীপুর লোকালে চেপে খড়্গপুর। খড়্গপুর থেকে ঘন্টা খানেক এর বাস এ চেপে ধবনি। এই ধবনি থেকে আমাদের গ্রাম মাত্র মাইল চার এক। সেখানে আমাদের গ্রাম রোহিনী। 

এই খড়্গপুরের ইতিহাস একটু বলে রাখি। কথিত আছে যে খড়্গেশ্বর এর নাম হতে খড়্গপুর এর উৎপত্তি। আবার অনেকে বলেন খড়্গেশ্বর রাজার তৈরী খড়্গপুর স্টেশন এর কাছে এই খড়্গেশ্বর মন্দির টি। তার নাম থেকেই খড়্গপুরের উৎপত্তি। যাই ঘটনা হোক না কেন আজকের এই খড়্গপুর পাঁচমিশালি মানুষের আনাগোনা। ওড়িশা রীতি , তামিল রীতি মিলে গিয়ে একাকার। অবশ্য গোটা দেশটাই পাঁচমিশালি। বৈচিত্রের মধ্যেই তো ঐক্য। যাই হোক না কেন , খড়্গপুর স্টেশন থেকে বাসে করে ধবনি রাস্তা টি খুব কষ্টকর। অবশেষে বিকাল ৪ তা নাগাদ। তারপর সেখান থেকে হাটা পথ। এই ধবনির অনেক কথা। চারিদিকে শুধু পাহাড়ের ছোট টিলা দেখা যাই। এমন ই একটি টিলা তে আওয়াজ করলে প্রতিধ্বনি হয়। সেখান থেকে ধবনি নাম টি এসেছে। ধবনির পাশ দিয়ে বয়ে চলছে কালিঘাই নদী। গ্রামের লোকেদের সবকিছু কে বিক্র্রিত করা একটা অভ্যেস। তাই ধ্বনির নাম আজ ধবনি। কালিঘাই নদীর নাম আজ কেলেঘাই। কালিঘাই নদী রূপনারায়ণ থেকেই তৈরী হয়েছে। সূর্যাস্তের সময় মেদিনীপুরের তথা গ্রামের রাস্তায় এই সূর্যাস্তের রূপ অতুলনীয়। লাল মাটির এই দেশে সূর্যাস্তের সময় চারিদিকে লাল মাটি তে সূর্যের আলো  তে আরো লাল হয়ে যায়। সেই লাল মাটি তে গোধূলির আলো লেগে আরো অপূর্ব সুন্দর লাগতো। ধবনি তে তখন সেইরকম কোনো সুযোগ সুবিধা ছিলো না। তখন শুধু ছিলো একটি চপ মুড়ির দোকান। সেই দোকানে চপ মুড়ি খেয়ে হাঁটা দিতে হবে। ও হা , হাঁটা দিতে হবে কারণ কোনো যানবাহন নেই। তখন মাটির পথ ছিলো পাকা রাস্তা ছিলো না। কোনো বাস , ট্যাক্সি , কোনো মোটর যান ছিলো না। ছিলো কেবল গরুর গাড়ি। তাও সেটা সূর্যাস্তে র আগে গ্রামে চলে যেত। ফলে হাটা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। তখন গ্রাম এ বিদ্যুৎ আসেনি ফলে সূর্যাস্তের পর গ্রামের মানুষ রাস্তায় বের হতো না। রাস্তায় কোনো এল ছিলো না। ফলে আমাদের ও অসুবিধা হতো।  কিন্তু কি করবো, গ্রামে পৌঁছেতে হবে যে। গ্রামের রাস্তা মাইল ২ মতন। এই রাস্তা হেটে পার হতে হবে। 


যাই হোক চপ মুড়ি খেয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। গ্রামের যাত্রার অভিজ্ঞতটা কত তা সুন্দর এইখান থেকে পাঠক বুজতে পারবেন। যাই হোক সে এক অন্নন্য অভিজ্ঞতার কথা, দারুন ভালো লাগার কথা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ২ কিমি এর বেশি রাস্তা তও আবার হেটে। সে যাত্রায় চারিদিকে শুধু শাল , মহুয়া এর জঙ্গল। যদিও সে সব আজ আর নেই কারণ সরকারি উদ্যোগে এখন চাষ করা হচ্ছে ইউকেলিপ্টাস যা অনেক লাভজনক ও গাছের অনেক উপকারিতা। কিন্তু শাল মহুয়া সেই অপরূপ সৌন্দর্য আর নেই। যদিও দু একটা মহুয়া গাছ এখনো মাঝে মাঝে দুএকটা দেখা যায় । মহুয়া গাছের সে অনেক কথা , হলুদ হলুদ ফুল হয় তাতে আবার মাদক দ্রব্য হিসাবে কাজ করে।  বাবা নাকি একবার এমন মহুয়া ফল খেফেলেছিলো তাতে অজ্ঞান হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। শাল গাছের অনেক গুন্ ও আছে , আছে অনেক উপকারিতাও। আসবাব ও বীম তৈরিতে এই কোনো বিকল্প নেই। আগেরদিন বাড়ির ছাদ শাল গাছের গুড়ি দিয়ে হত - শহরের দিকে সে সব আর পাওয়া  যায়  না , কিন্তু গ্রামে বাড়ি তৈরিতে এখনো শাল এর বীম ব্যবহার হয়। যাইহোক , অবশেষে সেই সল্ মহুয়ার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে , মাটির রাস্তা দিয়ে , গোধূলির আলো গায়ে মেখে গ্রাম এ পৌঁছিলাম। তখন মুখসন্ধ্যা। গ্রাম এ চারিদিকে তখন শঙ্খ ও উলুধনি এর আওয়াজে চারিদিক বিমোহিত। 


গ্রামের নাম রোহিনী। এই রোহিনী নামের তাৎপর্য আছে। জ্যোতিষ এ ২৭ টি নক্ষত্রের মধ্যে একটি নক্ষত্র এর নাম রোহিনী  , বোধহয় সেখান থেকেই এই নাম এসেছে। যাই হোক এই প্রসঙ্গে , একটা কথা বলতে হবে - রোহিনী নক্ষত্রের একটা তাৎপর্য আছে গ্রামের লোকের কাছে। যখন মানুষ বৈজ্ঞানিক ভাবে এতো উন্নত ছিলো গ্রামের চাষীরা মনে করতেন সূর্য যখন রোহিনী নক্ষত্রে প্রবেশ করে ( বৃষ রাশি , জ্যোষ্ট মাসের শেষে সপ্তাহ) তখন বর্ষা প্রবেশ করে। সেই সময় শুরু হয় ধান বোনা। যাই হোক , অবশেষে বাড়ি পৌঁছিলাম। আমাদের পূর্ববংশ সব এ এইখানে থেকে এসেছে। গ্রামে সে সব চিহ্ন তখন ছিল (এখনো অবশ্য আছে ) । শুরুতেই গ্রামে এ ঢুকতে ওঁম  ত্রৈলোক্যনাথ দাশ এর সমাধি ( আমার প্রপিতামহ তস্য প্রপিতামহ - সমাধি প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো।  আমরা বৈষ্ণব কাজেই দাহকার্যের পর সমাধি শাস্ত্র অনুযায়ী নিয়ম।) বিকালে গ্রামের লোকেদের খাবার চা আর মুড়ি। অবশেষে সেটাই খেলাম। গ্রামে ঢুকতেই তখন ছিলো একমাত্র স্কুল সেটা সবেমাত্র তৈরি হচ্ছে , বছর পাঁচ এক আগে তো স্কুল ও ছিলো না। সেই মাঠে তখন কচিকাঁচাদের ভিড়। গ্রামের লোকের কাছে প্রিয় খেলা কবাডি। 


কুয়ো থেকে জল তোলা , মুড়ি ভাজা , জ্বালানি জোগাড় করা - তারপর তখন ছিলো মাটির বাড়ি - তার অনেক পরিচর্যা। এখন যদিও সব এ  পাকা বাড়ি। কাজেই এখন মাটির বাড়ি শুধু কল্পনা। তখনও গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি কাজেই কেরোসিন এ একমাত্র ভরসা। হ্যাজাক , লণ্ঠন , হারিকেন , মোমবাতি এর কাজ রাত্রে। গ্রামের মায়েদের শহরের মায়েদের থেকে অনেক কাজ - কথাটা বটে। 


আমরা বাড়ি এসে পরিষ্কার হয়ে নিলাম। চা টিফিন খেয়ে নিয়ে বাবা চলে যেতেন মুরুব্বিদের সাথে কথা বলতে। বাবার জন্ম এইখানে , কাজেই শৈশব তাকে এখনো আকর্ষণ করে , কিন্তু আমাকে তো আর শৈশব আকর্ষণ করে না , আমাকে আকর্ষণ করে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য।  সারা বছর শহরে থেকে মাজখানে একটি সপ্তাহ গ্রামে যেন সম্পর্ণ অন্য জগতে আমি। মনেই হতো না যেন শহর থেকে অনেক দূরে। শহরে আমি মানুষের মাঝে আর গ্রামে এ আমি গাছপালা , পশুপাখি এর মাঝে। ... বার বার শুধু মনে পরে যেত রূপসী বাংলা কবি জীবনানন্দ দাসের কথা। যেন কবির কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। তাই বাড়ী থেকে বার বার ছুটে যাই জঙ্গলের দিকে। যাই হোক , রাত্রে বাবার সাথে আমিও মুরুব্বিদের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে যেতাম। 


এবার বংশপরিচয় একটু দেওয়া  যাক। রামসুন্দর শর্মা ও শ্যামসুন্দর শর্মা দুই ভাই কনোজ হয়ে সরকারি কাজে এসেছিলেন ঝাড়গ্রামে। তাদের চার পুত্র - গৌরহরি , জয়হরি , বিষ্ণুহরি , নরহরি। এই গৌরহরি এর তিন সন্তান( দ্বিতীয় বিবাহে, বৈষ্ণবে ) - ত্রৈলোক্যনাথ , কৈলাশ ( বংশ বিলুপ্ত) ও মতিলাল। ত্রৈলোক্যনাথ এর পুত্র জন্মেনজয় , তস্য পুত্র মতিরাম , তস্য পুত্র আমার পিতা। আবার মতিলাল দাস এর প্রথম বিবাহে পুত্র তারকব্রহ্ম  ও দ্বিতীয় বিবাহে ইন্দুবালা দেবী। মতিলাল দাস বড় সুচতুর লোকছিলেন। ক্ষমতা বলে তৎকালীন রাজার কাছ হতে রোহিনী গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন ও গ্রামের বিপুল জমির মালিকানা সহ জমিদারিত্ব লাভ করেন। জমিদার( সরকারি ভাষায় তহসিলদার , যারা কিনা ইজারাদার দের কাছে থেকে জমি নিয়ে যথোপযুক্ত কর দিয়ে গ্রাম এর মালিকানা দখল করতেন।) মতিলাল দাসের একমাত্র পুত্র তারকব্রহ্ম দাস তখন বেঁচে। এখনো বেঁচে আছেন এবং যদিও বেঁচে থাকার এ কথা কারণ বয়স এখনো ৮০ পার হয়নি। এখনকার এই যে লেখার কথা , গ্রামের কথা , কাহিনী ও ইতিহাস সব এ উনার কাছে থেকে সোনা। আমি যখন কথা বলছি গ্রামে তখন কোনো পাকাবাড়ি ছিলো না , কেবলমাত্র এই জমিদার বাড়ি ছাড়া।  সে বাড়ি না দেখলে মনে হয় না এই ভাবে বাড়ি বানানো যায় বোলে। আমরা যেইভাবে ইষ্টক ব্যবহার করি , ঠিক সেইভাবে গরুর গাড়ি করে পাথর এনে তার পর সেই পাথর গাঁথনি করে বাড়ি বানানো। আরো বিশেষত চাঁদটা , বিশেষ ভাবে বানানো - শাল এর বিম দিয়ে , তারপর স্ল্যাব বানিয়ে সেগুলো জুড়ে দেওয়া। আসলে হয়তো বোঝাতে পারলাম না কারণ এটাও আমার সোনা কথা। যাই হোক , এই জমিদার পরিবার ও আমাদের আত্মীয় হয় হয় তবে অনেক দূরের। সম্পর্কে তারকব্রহ্ম  দাস মহাশয় আমার বাবু  হবে - আমাকে বলা হতো ছোট বাবু বলতে তো তাই বলতাম। তখন যখন গ্রাম যেতাম তখন জমিদারির অস্তাচলগামী সূর্যের আভাস তখনো কিছু ছিলো যা এখন আর আর নেই। গ্রাম যা হতো না তা তো হতোই এমন কি শহরে যা হতো না তও হতো।  তাদের বাড়িতে বিশাল বারো করে রথের উৎসব হতো , কালীপুজো তে এ ডজন পাঠা বলি হতো , বাড়িতে নিজের গরুর ঘি আরো অনেক কিছু। তিনি এক বেঁচে নেই কিন্তু সোনার দিকে তাকালে যেমন তা অরশ্মি বিকিরণ করে তাই আজ সেই জমিদারি সুর আক্কাকী গান যে যাই। বাড়িতে নিজের মন্দির ও সেই মন্দিরে তিনশত বছরের পুরোনো  দেব দেবী বিগ্রহ - রাধানাথজীউ , মদনমোহন জিউ  , নারায়ণ শীলা ও আরো কত কিছু। যাই হোক , বাবা প্রথম এদেরবাড়ি আসতেন। এসেই , একদম তাজা গরুর দুধে চা - যে স্বাদ শহরে কোনোদিন এ পথ যাবে না , যেত না। আমি গিয়ে প্রথমে গরু গুলি কে আদর করতাম( কারণ শহরে ওটা পথ যেত না) , আমি মুরগি গুলো কে ধরতে যেতাম কারণ ওটা শহরে হতো না।  মন্দিরের ঠাকুরের সামনে থাকতাম কারণ ওটাও শহরে পেতাম না। সব মিলিয়ে দারুন লাগতো। ছোট বাবু এর সাথে হতো শুধু সম্পত্তির গল্প - কারণ উনার ৭৭ এ বর্গা তে অনেক জমি বেরিয়ে গেছিলো। বর্গা হয়ে গিয়েছিলো জমিদারিত্ব , রাজনীতি ও গণতন্ত্র ভাগ বসলো উনার অনেক জমি তে , গণতন্ত্র কেড়ে নিলো জমিদারিত্ব । তাই তো তিনি আজ  বোধেহয় আমাদের ও সমান। অবশ্য আমরা সন্মান পেতাম কারণ একই গোত্র ও বংশের লোক বলে। কিন্তু বর্গা এর মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হবার অভিজ্ঞতটা উনার ছিলো  তাই তো উনি সকলের কাছে , বিশেষত আমার বাবার কাছে বিশেষ মূল্যবান। তাঁর উপদেশ এর বিশাল মূল্য। বাবা উনার কাছে থেকে কিভাবে সম্পত্তি সামলাতে হয়ে থাকে তা সম্পর্কে বিশেষ গান নিতেন। সেদিন রাত্রে উনার কাছেই কিভাবে সম্পত্তি রাখা করতে হবে তা সম্পর্কিত অনেক কথা শুনে রাট সম্পূর্ণ করে আবার বাড়ি ফিরতাম। বাড়িতে কাঠের উনানে রান্না সে স্বাদ সত্যি অন্যরকম ছিলো।  ভাত  র সাথে আলু ভাজা , ডাল  ও মাছ ভাজা - সত্যি তার স্বাদ ছিলো অন্য রকম। গ্যাসের আগুনের রান্না এর  সাথে কাঠের আগুনের রান্না এর স্বাদ সত্যি অন্যরকম। যাই হোক গ্রামের রান্না খেয়ে  নিয়ে শুয়ে  পড়লাম। 


পরদিন সকালে দারুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। উঠেই কুয়ো এর জলে দাঁত  মেজে , মুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে নিলাম। তারপর পুকুরে যাবার পালা। পুকুরে গিয়ে স্নান। গ্রামের মহিলা দের সকাল সকাল স্নান করতে যাওয়া একটা রীতি ছিলো , এখনো আছে। তাই কাকিমা ও মায়ের সাথে স্নান করতে যাত্রা শুরু করে দিলাম। উত্তরে সবথেকে ভালো পুকুর কেউদি। শাপলা সালুকে ভরা , পদ্ম ফুলের তো তখন মরসুম নয় তাই ফোটেনি। কিন্তু শাপলা , পদ্মে , শালুক ফোটা ফুলে আমার খুব ভালোই লাগতো। জল ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল করে আওয়াজ র ডুব কয়েকটা ডুব দিয়ে উঠে পড়তাম।  পুকুরের পাশেই ছিলো  কাঞ্চন ফুলের বাগান , সেখানে থেকে কাঞ্চন ফুল সহ আরো অনেক ফুল নিয়ে আসতাম। মা ও কাকিমা ফুল , বেলপাতা নিয়ে এসে ঠাকুরের পুজো দিতো। তারপর শুরু হতো রান্না করা। অত্যাধুনিক মাইক্রো ওভেন তো দূরের কথা শহরেই তখন অনেক কাঠে বা গুলি কয়লায় রান্না হতো। তাই গ্রামে আরো পিছিয়ে গিয়ে পাতায় রান্না হতো। জঙ্গল থেকে আদিবাসীরা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে আসতো  - দাম এখনো মনে আছে ১০ টাকা করে বস্তা , সেই পাতা দিয়ে রান্না হতো। একজন আদিবাসী মহিলা দিনে এমন ৫ বস্তা আর পুরুষ হলে ১০ বস্তা পাতা বিক্রি করত। পাতার আগুনে রান্নার সে অপূর্ব স্বাদ ছিলো। বিশেষত ভাত এর।  সেই স্বাদ আজ মাইক্রো ওভেন ও পাওয়া যাই না। 


বিকালে গাজন। বাঁধনা পরব , টুসু ভাদু নাচ , গ্রাম্য দেবতার পূজা(করম, শীতলা, গরাম, জুগ্নী প্রভৃতি লোকদেবতার) , গোষ্ঠপূজা এবং আরো অনেক কিছু। তখন গ্রামের লোকেরা তাদের বাড়িতে টিভি কিনতে পারতো না তাই ওই গাজনে হতো ভিডিও। বিভিন্ন বাঙালি সিনেমা। .উত্তম সুচিত্রা ইত্যাদি ছিলো এর অঙ্গ। আর আসতো কামার পাড়া থেকে বিভিন্ন রং যে রঙের আঁকা কলসি , হাড়ি। আস্ত আখের শরবত। বিক্রি হতো চাল ভাজা ( বাবা চা দিয়ে খেতে খুব ভালো বাসতো ) । সবথেকে মজার যেটা হতো সেটা হলো বিভিন্ন বাজি ধরা খেলা - একদল মুরগি লড়াই খেলতো , একদল কুস্তি ইত্যাদি তে ব্যাস্ত থাকতো। সব কিছুর শেষে ভাঙা মেলা থেকে কিনে নিয়ে আসতাম অনেক খেলনা - যদিও সেগুলো খেলা হতো না। .. শোকেসে আজও শোভা পাচ্ছে স্মৃতি হিসাবে।


এইভাবে কত ঠিক গুনে গুনে ৭ টা দিন। ঠিক পরের রবিবার বাড়ি ফেরার পালা।আবার সেই শহর। গ্রামের সহজ সরল জীবন ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করতো না।গ্রামের স্মৃতি গুলো আজও মনে দাগ কেটে যাই আজ গ্রাম আছে কিন্তু সেই রূপসী বাঙালির জীবন আর নেই , এসেছে আধুনিকতার ছোয়া , ছেড়ে চলে গেছে গাজন , নবান্ন উৎসব। লোকগীতি এর শিল্পীরা ও তাদের গানের মূল্য আজ কের মানুষের কাছে অনেক কম। তাই তাদের পরের প্রজন্ম এইসব পেশায় কোনো স্বপ্ন না দেখে পারি দিচ্ছে শহরে। ..হারিয়ে যাচ্ছে বাঁধনা পরব , টুসু ভাদু নাচ।.... আধুনিকতার ছোয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে মাটির শিল্পীরাও। .. কাঠের রান্নার স্বাদ আজ আর মাইক্রোওভেন পাওয়া না ( যদিও বিরিয়ানি ও কিছু সাবেকি রান্না কাঠে করার রীতি এখনো আছে ) ...স্মার্টফোনে এর যুগে মুরগি লড়াই হাস্যকর।

তবে গাজন এখনো হয় , কিন্তু সেটা ছোট করে , স্মার্টফোনের ও ক্যামেরার সুযোগে কিছু ফটো এইখানে দিলাম। আর হা তবুও যেতে হবে। স্কুল , পড়াশুনা আছে যে। ...